করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সারা পৃথিবীতে এই পর্যন্ত মারা গেছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ। প্রযুক্তিগত ভাবে উন্নত দেশগুলোতেও মৃতের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। মৃত্যুহারের তালিকায় প্রথম দশটি দেশের মধ্য আছে কানাডা এবং ফ্রান্স। আমেরিকায় মৃতের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। এই পরিস্থিতিতেও একটি দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা এখনো শূন্য, সর্বমোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ৩৭০ জন। দেশটির নাম ভিয়েতনাম। ভিয়েতনাম অর্থনৈতিকভাবে খুব উন্নত নয়। আহামরি কোন চিকিৎসা ব্যবস্থাও নেই দেশটির; প্রতি দশ হাজার মানুষের জন্য সেখানে চিকিৎসক মাত্র চারজন। সবচেয়ে বড় কথা চীনের সাথে ১৪৪৪ কিলোমিটার বর্ডার আছ ভিয়েতনামের। তাহলে দেশটি করোনা মোকাবেলায় এত সফল হল কিভাবে?

ভিয়েতনামের এই সাফল্যের কারণ হল দেশটির অতি দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ। অনেকেই তাদের কর্মপদ্ধতিতে ‘অ্যাগ্রেসিভ’ বলেছিলেন। কিন্তু ‘অ্যাগ্রেসিভ’ পদক্ষেপ গুলোই দেশটিতে করোনা পরিস্থিতি টিকে থাকলে সাহায্য করছে। করোনা মোকাবেলায় তার কাজ করতে শুরু করেছে জানুয়ারি মাসের প্রথম থেকে; তখনও ভিয়েতনামে কেউ করোনা আক্রান্ত হয়নি। কিন্তু তারা তখন থেকেই তার উহান থেকে আগত বিমান যাত্রীদের ‘ট্যাম্পারেচার স্ক্রিনিং’ শুরু করেছে। মধ্য জানুয়ারি থেকে ভিয়েতনাম বর্ডার, বিমান বন্দর আর সমুদ্র বন্দর গুলোতে কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করেছে। ভিয়েতনামে প্রথম করোনা সনাক্ত হয় জানুয়ারির ২৩ তারিখে। সাথে সাথে উহান থেকে আসা সবগুলো ফ্লাইট বাতিল করে ভিয়েতনাম। ফেব্রুয়ারির এক তারিখে, যখন দেশটিতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ৬ জন তখনই তারা করোনাকে জাতীয় ইপিডেমিক হিসেবে ঘোষণা করে। চীনের সাথে বিমান যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার পাশাপাশি সাথে চীনের নাগরিকদের ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। পরপর থেকে যে দেশেই করোনা রোগী সনাক্ত হয়েছে, সেই দেশের সাথে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করছে ভিয়েতনাম। মার্চের শেষের দিকে দেশটিতে কোন বিদেশীকেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তাছাড়া মার্চের ১৬ তারিখে মাস্ক ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করা হয়।
করোনাভাইরাস যাতে না ছড়াতে পারে সেজন্য লক-ডাউনের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে দেশটি। ১০০০০ মানুষ বাস করে এমন একটি গ্রামকে বিশ দিন লক-ডাউন করে রাখা হয়েছিল মাত্র সাত জন করোনা রোগী সনাক্ত হওয়ার পরে।
রোগ সংক্রমণ রোধ করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং। কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং বলতে বোঝায় একজন রোগী সনাক্ত করার পর কে কে তার সংস্পর্শে এসেছে তার তালিকা তৈরি করা এবং তাদের পর্যবেক্ষণে রাখা। এই কাজটিও অত্যন্ত সফলতার সাথে করেছে ভিয়েতনাম। কোন করোনা রোগী সনাক্ত করার সাথে সাথে তার সংস্পর্শে যারা এসেছে তাদের বাধ্যতামূলকভাবে দুই সপ্তাহের জন্য কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এইজন্য বিপুল পরিমাণ লোকবল নিয়োগ করতে পিছ-পা হয়নি তারা।
ভিয়েতনাম সরকার মাইকিং, প্রেস, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে পপ তারকাদের পর্যন্ত কাজে লাগিয়েছে জনসচেতনতা বাড়াতে। ভিয়েতনামের একটি জনপ্রিয় গানের সুরে “হাত ধোয়া গান” নামে একটি জনসচেতনতা মূলক গান প্রচার করা হয়েছে। গানটি দ্রুত ভাইরাল হয়েছে। এই পর্যন্ত এটির ভিউ ৪৮ মিলিয়ন ছাড়িয়েছ।
ইউরোপের কয়েকটি দেশে এবং আমেরিকার কয়েকটি প্রদেশে ফেস মাস্ক এবং সোশ্যাল ডিসটেনসিং বাধ্যতামূলক করা সম্ভব হয়নি জনগণের তীব্র আপত্তির কারণে। আবার এগুলো বাধ্যতামূলক করার পরও অনেকে মাস্ক পরতে বা সোশ্যাল ডিসটেন্সিং মেনে চলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ভিয়েতনাম সরকারকে এই সমস্যার পড়তে হয়নি। ভিয়েতনামের সচেতন জনগণ প্রথম থেকেই করোনাকে সিরিয়াসলি নিয়েছে এবং সরকারের যাবতীয় নির্দেশনা মেনে চলেছে।